বুধবার, আগস্ট ৬, ২০২৫
No menu items!
spot_img

রোগীর পেটে কাঁচি রেখেই সেলাই, ৭ মাস পর অপসারণ

বরগুনার একটি বেসরকারি ক্লিনিকে কোহিনুর বেগম নামে ষাটোর্ধ্ব এক নারীর জরায়ু অপারেশনের পর পেটের মধ্যে কাঁচি রেখে সেলাই করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। এ ঘটনার দীর্ঘ সাত মাস পর পুনরায় আরেকটি অপারেশন করে ওই নারীর পেট থেকে কাঁচিটি উদ্ধার করা হয়। তবে দীর্ঘদিন পেটের মধ্যে কাঁচি থাকায় খাদ্যনালীতে পচন ধরে বর্তমানে মৃত্যুশয্যায় দিন কাটছে ভুক্তভোগী ওই নারীর। 

বুধবার (৯ জুলাই) বিষয়টি জানাজানি হয়। এ ঘটনায় ন্যায় বিচার পেতে মঙ্গলবার (৮ জুলাই) জেলার সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বজনরা।

বরগুনা সদর উপজেলার ২নং গৌরীচন্না ইউনিয়নের কুয়েত প্রবাসী নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে। স্বজনদের অভিযোগ, বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. ফারহানা মাহফুজ ওই হাসপাতালে কোহিনূর বেগমের অপারেশন করেন। এছাড়া তার সঙ্গে কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালের নিয়মিত চিকিৎসক ডা. সাফিয়া পারভীনও ছিলেন বলে জানান তারা।

ভুক্তভোগীর স্বজন সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালীর কলপাড়া উপজেলার বালিয়াতলী নামক এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী কোহিনুর বেগম। গত বছর তিনি মেয়ের বাড়ি বরগুনায় বেড়াতে আসেন। পরে তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে সদর উপজেলার ২নং গৌরীচন্না ইউনিয়নের কুয়েত প্রবাসী নামে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জরায়ুর সমস্যা ধরা পরলে গত বছরের ১৮ নভেম্বর ওই বেসরকারি হাসপাতালেই কোহিনুর বেগমের একটি অপারেশন হয়। তবে তার পেটের মধ্যে ৭ ইঞ্চি সাইজের একটি কাঁচি রেখেই সেলাই করে অপারেশন সম্পন্ন করা হয়। ফলে হাসপলে ৪ দিন ভর্তি থাকার পর বাড়িতে গেলে কোহিনুর বেগমের অবস্থা আরও অবনতি হতে শুরু করে। এরপর গত কয়েকমাস ধরে অবস্থার বেশি অবনতি হলে স্বজনরা কোহিনুর বেগমকে নিয়ে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। সেখানে পুনরায় তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে পেটের মধ্যে একটি কাঁচি শনাক্ত করেন চিকিৎসকরা। পরবর্তীতে গত ১৮ জুন আরেকটি অপারেশন করে ওই কাঁচিটি অপসারণ করা হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে পেটের মধ্যে সাত ইঞ্চি লম্বা একটি কাঁচি থাকায় পচন ধরেছে কোহিনুর বেগমের খাদ্যনালীতে। এতে তার খাদ্যনালীর একাংশ কেটে ফেলতে হয়েছে। আর এ কারণেই বর্তমানে স্বাভাবিক মলত্যাগ করতে পারছেন না কোহিনুর বেগম। চিকিৎসকরা তার পেটের সঙ্গে বাইরে একটি ব্যাগ যুক্ত করে দিয়েছেন, যেখানে জমা হচ্ছে মল। বর্তমানে মুমূর্ষ অবস্থায় বিছানায় শয্যাশায়ী আছেন কোহিনুর বেগম।

কোহিনুর বেগমের ছেলে ইসা বলেন, আমরা দুই ভাই তিন বোন এবং বাবা বৃদ্ধ। আমাদের কারো তেমন ভালো কোনো আয়ের উৎস নেই। মায়ের চিকিৎসার জন্য বরগুনা কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার অপারেশনের পর একটি কাঁচি পেটে রেখে সেলাই করে দেয় ডা. ফারহানা মাহফুজ। এ ঘটনার সাত মাস পর বিষয়টি জানতে পেরে ওই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় এখন মায়ের চিকিৎসা খরচ মিটাতে পারছি না। আমার মায়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচার চাই।

ভুক্তভোগী কোহিনুর বেগমের মেয়ে ফাহিমা বেগম বলেন, বরগুনা একটি জেলা শহর হওয়ায় কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালে আমার মায়ের অপারেশন করাই। তবে তিনি ধিরে ধিরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে কলাপাড়ায় তাকে ডাক্তার দেখাই। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার পেটে একটি কাঁচি ধরা পরে। বর্তমানে আমার মা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। প্রতিদিন প্রায় তার পেছনে ২-৩ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এছাড়াও হাসপাতালের অন্য খরচ বহন করতে না পারায় মাকে নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছি। তিনমাস পরে আবারও আরেকটি অপারেশন করতে হবে বলেও জানান তিনি।

কোহিনুর বেগমের মেয়ের জামাই মো. হুমায়ুন বলেন, আমার শাশুড়ির অপারেশনের পর চার দিন কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালে ভর্তি ছিল। পরে বাড়িতে এসে অপারেশনের জায়গায় ইনফেকশন হলে আবারও ওই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ১১ দিন তাকে ভর্তি রাখা হয়। এরপর থেকে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হতে শুরু করলে বরিশালে নিয়ে গেলে তার পেটের মধ্যে একটি কাঁচি ধরা পরে। তবে এ ঘটনায় কুয়েত প্রবাসী হাসপাতাল কতৃপক্ষ আমাদেরকে কোনো প্রকার সহযোগিতা না করে উল্টো হুমকি দিয়েছে।

আল মামুন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা চিকিৎসকের দায়িত্ব অবহেলায় হয়েছে। সাত ইঞ্চি লম্বা একটা কাঁচি ছোট নয়, যা দেখা যাবে না। একটি ভুলের কারণে ওই পরিবারটি শেষ হয়ে গেছ। তাদের চিকিৎসা খারচ মেটানোর টাকা না থাকায় বিভিন্ন জায়গায় তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পরেছেন। তদন্ত সাপেক্ষে ওই হাসপাতালসহ জড়িত সকলের বিচারের দাবি জানাই।

ভুক্তভোগী কোহিনুর বেগমের অপারেশনের পর তার পেটের মধ্যে কাঁচি রেখে সেলাই করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে সরেজমিনে কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালে গেলে পাওয়া যায়নি অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. ফারহানা মাহফুজকে। পরে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী মো. ফজলুল হক (মন্টু) বলেন, কোহিনুর বেগমের জরায়ু অপারেশন হয়েছিল। তার অপারেশন করেছিল সরকারের হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফারহানা মাহফুজ। পর সুস্থ হয়ে রোগী বাড়ি চলে গেছিলেন। দীর্ঘ সাত আট মাস পর তারা আমাকে এ ঘটনা জানায়। পরে বরিশাল গিয়ে আমি তাদের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, আমারতো কোনো ত্রুটি নেই। এছাড়া অপারেশন যে ডাক্তার করেছে তার যদি কাগজপত্র না থাকতো তাহলে আমি দায়ী থাকতাম। তবে রোগীর স্বজনরা গত সাত-আট মাসে রোগীর অসুস্থতার বিষয়ে হাসপাতালে কোনো যোগাযোগ করেননি বলেও জানান তিনি।

বরগুনা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ বলেন, আমি চার মাস হয়েছে বরগুনায় যোগদান করেছি। এখানে ১২৫টি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। অভিযুক্ত কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালের মালিকসহ সবাইকে তলব করা হয়েছে। তাদের সব কাগজ পত্র দিতে বলেছি। কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি উঠেছে সে বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের বিধি মোতাবেক তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া কোহিনুর বেগম নামে ভুক্তভোগী ওই নারীর সকল অভিযোগ আমি আমলে নিয়েছি। এই ধরনের মানহীন ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসনসহ জেলা বিচার বিভাগের সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular